গ্রামের ধুলোভরা পথটার দুপাশে ঘন বন। গ্রামটি হলো ফকিরহাটের জাড়িয়া। দুপাশ থেকেই হাতা-পাতা বাড়িয়ে নানান রকম বুনো লতা ও শটি-কচু-ভাঁট ফুলের গাছেরা পথটার অনেকখানি দখল করে নিয়েছে। আশপাশে জনবসতি নেই। শুধু দেখছি ও শুনছি শ্যামাপাখি ও ওদের মনকাড়া শিস ও গানের শব্দ।
আমি ও দুজন কিশোর ওই পথটা ধরেই হেঁটে চলেছি ভরদুপুরে। হঠাৎই একটি বড় বেজি ডান পাশের বাগান থেকে যেন ছিটকে উঠে এল পথটার ওপরে। আমাদের দিকে তাকাল রাগত চোখে, তেজি ভঙ্গিতে দুকদম এগিয়ে এল আমাদের দিকে। শরীরের লোমগুলো ফুলিয়ে রেখেছে। লেজটা সাপটাচ্ছে মাটিতে, আমরা থামলাম। তাকে আমি সর্বশেষ দেখেছিলাম ১৯৮৬ সালে। রোমাঞ্চিত হলাম। দুঃসাহসী ও ভীষণ রাগী ও তেজি বেজিটা তাহলে আজও আছে এই এলাকায়—যাদের বাল্য-কৈশোরে মাঝেমধ্যেই দেখতাম!
বিষধর সাপকে যে প্রাণীটি চরম কুশলতায় ও ধূর্ততায় ক্লান্ত-শ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত করে মেরে ফেলে, পোষা কুকুর-বিড়ালকে যারা থোড়াই কেয়ার করে, চরম দুঃসাহসে দুটি প্রাণী মিলে রাজহাঁস পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে, সেই প্রাণীটি হলো বড় বেজি। লড়াকু-বুদ্ধিমান ও দৌড়বিদ এই প্রাণীটি খায় ফসলের খেতের বড় বড় ইঁদুরসহ ছোট সাপ, মাছ, ব্যাঙ, পোকা-পতঙ্গ-ছোট পাখি। বুনো পাখি শিকারে এদের পারদর্শিতা ঈর্ষণীয়। ডাঙায় কচ্ছপ পেলে এরা কচ্ছপের সঙ্গে মজার খেলায় মাতে। পা দিয়ে উল্টে দেয়। উপুড় হলে আবারও উল্টে দেয়। পথরোধ করে। বিড়ালের মতো এরাও ‘ইঁদুর-বেজি’ খেলায় মাতে। সঙ্গে বাচ্চা থাকলে এরা কোনো শত্রুকেই খাতির করে না। পোষা হাঁস-মুরগির ছানাদের বাগে পেলে এরা সবগুলোকে মারবে আগে, তারপরে মুখে ধরে নেবে হয়তো দু-একটাকে। অকারণে মারার প্রবণতা এদের রয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা এই বলে যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবলে এরা দূরের সাপেরও সন্ধান পেয়ে যায়। লাফ দিতে পারে চার ফুট উচ্চতায়।
এদের সঙ্গে প্রায় সারা বছরই দু-তিনটি করে বাচ্চা দেখা যায়। উইয়ের ঢিবি, উঁচু জায়গাসহ সুবিধামতো জায়গায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাচ্চা দেয়। মেয়ে বেজি একাই বাচ্চা লালন-পালন করে। প্রয়োজনে বাচ্চার ঘাড় কামড়ে ধরে স্থানান্তর করে।
বড় বেজির রং একনজরে ধূসর ছাই। শুধু শরীরের মাপ ৩৭-৪৮ সেমি। লেজ ৩৩-৪৫ সেমি। ওজন দেড়-দুই কেজি। এদের গর্ভধারণকাল ৬০-৬৫ দিন। প্রতি প্রসবে ছানা হয় ২-৪টি। সারা দেশেই আছে এরা, তবে সংখ্যায় খুবই কম। বেশি দেখা যেতে পারে সুন্দরবন লাগোয়া জেলাগুলোতে ও দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে। ফকিরহাট-বাগেরহাটে ছিল। ৩০ বছর বাদে গত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে নিজ চোখে দেখে বুঝলাম, এ এলাকায় এরা আজও আছে। এদের ছোট ভাই ছোট বেজি (Small Indian Mongoose)। ছোট ভাইয়েরা বড় ভাইদের যেমন সমীহ করে, তেমনি বড় ভাইয়েরাও ছোটদের ভালো নজরে দেখে।