বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার পর প্রথম রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি

ডেস্ক নিউজ : করোনা মহামারীর কারণে বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এটি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা কম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাথমিক হিসাবে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো রাজস্ব আদায়ে এবারই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হল। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে চলতি ২০২০-২১ সালে করফাঁকি রোধ ও নজরদারি বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কৌশল নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মঙ্গলবার এমন বার্তা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। করোনার কারণে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা ছিল। আর বাস্তবেও সেটি হয়েছে। এনবিআরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে যা পরবর্তীতে সংশোধন করে ৩ লাখ ৫শ’ কোটি টাকা করা হয়। বিপরীতে অর্থবছর শেষে আদায় হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এটিও সাময়িক হিসাব।

চূড়ান্ত হিসাবে ঘাটতি আরও কমবে। আর প্রবৃদ্ধির হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর গঠনের পর প্রথমবারের মতো রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে প্রতিবছরই সামান্য হলেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এনবিআরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে, ৬৭ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ’৭৫-৭৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯৯৯-২০০০ সালে, ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। এবারই প্রথম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হল।

মঙ্গলবারের বৈঠকে রাজস্ব আয়ের বিষয়টি ব্যাপকভাবে উঠে আসে। উপস্থিত সূত্রগুলো জানিয়েছে, সোমবার আয়কর কমিশনার ও মঙ্গলবার কাস্টমস-ভ্যাট কমিশনারদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। মিটিংয়ে বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস আইনে পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পায় রাজস্ব আদায়ের কর্মকৌশল। রাজস্ব আদায় কার্যক্রম কীভাবে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যায়, সে বিষয়ে কমিশনারদের মতামত জানতে চান। কমিশনাররা ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর আইনের আইনগত পরিবর্তন তুলে ধরে রাজস্বের আদায়ের সম্ভাব্যতা তুলে ধরেন। এর প্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে ফাঁকি বন্ধ ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে, করোনার প্রভাবে অর্থনীতি এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি। স্থানীয় পর্যায়ে ভোগ-চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। এ অবস্থা চলমান থাকলে কাক্সিক্ষত হারে ভ্যাট আদায় সম্ভব নয়। তাছাড়া বাজেটে আইনে যে সব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে ভ্যাটের এত বিশাল লক্ষ্য আদায় দুঃসাধ্য ব্যাপার।মোবাইল ও সিগারেট খাতে করহার বাড়ালেও অন্য অনেক খাতে ছাড় দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু খাতে ভ্যাট হার বাড়ালেও তা খুবই নগণ্য। এতে এই দুই খাত ছাড়া অন্য খাতে ভ্যাট কমার সম্ভাবনা আছে।’ সোমবারের বৈঠক সম্পর্কে আয়করের একাধিক কমিশনার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান থাকলে আয়কর খাতে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

কারণ আয়কর আদায় হয় প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর। বর্তমানে কোম্পানিগুলোর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। এ অবস্থায় আয়কর আদায় গত বছরের চেয়ে কমতে পারে। কোম্পানি প্রচার ব্যয়ে সীমা নির্ধারণ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে টার্নওভারের সীমাহ্রাস, গাড়ি নিবন্ধনে উৎসে কর বৃদ্ধির কারণে আয়কর আদায় বাড়বে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে করোনা কতদিন থাকে, তার ওপর। সহসাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আইনগত পরিবর্তনগুলোও কাজে আসবে না। বৈঠকে কর্মকর্তারা এনবিআর চেয়ারম্যানকে আরও বলেন, করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে আয়কর আদায় মারাত্মকভাবে কমার আশঙ্কা রয়েছে। মানুষের হাতে টাকা না থাকায় অনেকেই কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ তারা রিটার্ন দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। বিদ্যমান করদাতাদের কাছ থেকে রিটার্ন পাওয়া চ্যালেঞ্জিং।

কাস্টমস ও ভ্যাটের কমিশনাররা বলেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, করোনার কারণে নতুন অর্থবছরে করের হার বাড়ানো হয়নি। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা গেলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তা বড় নিয়ামক হবে। এজন্য তিনি নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ’প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ভ্যাট খাতে, ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এরপরের অবস্থানে আছে আয়কর, ১ লাখ ৩ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। আর শুল্ক খাতে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এবার রাজস্ব আদায়ের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিষয়টি আগেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। ১৪ মে অর্থসচিবকে পাঠানো এক চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে আহরিত সর্বমোট রাজস্ব ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার বিপরীতে চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের শেষে সর্বমোট ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আহরিত হতে পারে, যা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কম। বর্তমান ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা।

দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হওয়ায় যা আহরণ এক প্রকার অসম্ভব বিবেচনা করা যায়। ওই চিঠিতে নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, অর্থবছরের শুরু থেকে দুর্যোগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থনীতির ওপর বিপুল প্রতিক্রিয়ায় আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না। আগের বছরগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। ওই হিসাবেও ২০২০-২১ অর্থবছরের ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় হওয়ার কথা না। কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটিও দুরূহ হবে।

এই বিভাগের আরো খবর