শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শতাব্দীর সংস্কারক সেই আলেমের খোঁজে

ডেস্ক নিউজ : ইসলাম জীবন্ত ধর্ম এবং জাগ্রত-চেতন মানুষের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত। আর ইসলামের জন্য জাগ্রত-চেতন মানুষেরই প্রয়োজন। আল্লাহ ইসলামের জন্য এই নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, সব সময় তাঁর জন্য জাগ্রত চেতনাসম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে। কোনো গাছ ততক্ষণ পর্যন্ত সবুজ ও প্রাণবন্ত মনে করা হয় না, যতক্ষণ না তা ফলদায়ক হয় এবং তাতে সবুজ ডাল ও পাতা খেলা করে।

নিয়ম হলো প্রদীপ থেকে প্রদীপ প্রজ্বলিত হবে; এবং তা হতেই হবে। উম্মাহর অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে জাগ্রত ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে হবে—যার জ্ঞানবৃক্ষ, চিন্তাবৃক্ষ, কল্যাণকামিতা ও আধ্যাত্মিকতার বৃক্ষ নতুন নতুন লতা-পাতার জন্ম দেবে, নতুন শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করবে। হাদিসে বলা হয়েছে, আমার উম্মত রহমতের বৃষ্টির মতো। কেউ বলতে পারে না তার প্রথম ফোঁটা মাটিকে বেশি সজীব করেছে না শেষ ফোঁটা।

পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষীদের কর্মযজ্ঞ, তাঁদের নিষ্ঠা ও সততা, আল্লাহর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক, তাঁদের দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস পরবর্তীদের জন্য সর্বোত্তম পাথেয় ও পথপ্রদর্শক। আমরা সব সময় বলি, আমাদের পূর্বসূরিরা এমন ছিলেন, তাঁদের মুখস্থ শক্তি এত প্রখর ছিল এবং তাঁরা সুগভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তবে তাঁদের জীবনচর্চায় এতটুকু যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন তাঁদের জীবনের বৈপ্লবিক চেতনা ও উম্মাহর নেতৃত্বে তাঁদের অতুলনীয় প্রজ্ঞাময় কর্মকাণ্ডও আলোচনা করা। ইসলামকে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত মানুষের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন আর অনাগত মানুষের সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য প্রয়োজন জাগ্রত বোধ ও চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।

চলমান পৃথিবী ও বাস্তবতার সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই সে গতিশীল ও সমকালীন মানুষের নেতৃত্ব দিতে পারে না। এমন ব্যক্তির মাধ্যমে উপকৃত হওয়া সম্ভব, তবে সে সময়ের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। কোনো জাতির বহু কিছু আছে; বড় বড় পাঠাগার আছে, সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে; কিন্তু জাগ্রত-চেতন ব্যক্তিত্ব নেই—যার হৃদয় থেকে, যার গবেষক মন থেকে, পাণ্ডিত্য থেকে ও যার দূরদৃষ্টি থেকে আমরা আলো গ্রহণ করব। এমন জাতির ভবিষ্যৎ কী?

বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ প্রত্যেক শত বছরে এই উম্মতের জন্য একজন ব্যক্তি প্রেরণ করেন, যিনি তাদের দ্বিনি বিষয় সংস্কার করেন।’ অর্থাৎ আল্লাহ প্রত্যেক শতাব্দীতে একজন সংস্কারক পাঠান যে দ্বিনকে সজীব ও গতিশীল করেন এবং দ্বিনি সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেন।

দ্বিনি সংস্কার কোনো সাময়িক বিষয় নয়, যা এক-দুই সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে; বরং তা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মনীষী আছেন, যাঁদের প্রভাব কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

রেললাইনে মানুষ একটি ছোট গাড়ি চালাত, সম্ভবত তা এখনো চলে—যার নাম ট্রলি। প্রথমে মানুষ তাতে ধাক্কা দেয়। এরপর তাতে বসে যায় এবং তা চলতে থাকে। গতি কমে গেলে নেমে আবার ধাক্কা দেয় এবং তাতে বসে পড়ে। এই উম্মতের গাড়িও অনুরূপ। আলেম ও মুজাদ্দিদরা হলেন ধাক্কা দানকারী। তাঁরা উম্মতকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যান। একবার ধাক্কা দিয়ে তাঁরা থেমে যান না। একবার ধাক্কা দিলেই তা চলতে থাকে না। গাড়ি নিজের চাকার ওপরই এগিয়ে যায়। তবে তাকে এগিয়ে নিতে একজন জাগ্রত-চেতন মানুষের প্রয়োজন হয়। উম্মতকে সামনে এগিয়ে নিতে কোনো প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়। ট্রলি চলতে দুটি জিনিসের প্রয়োজন হয়—এক. গতিশীল চাকা, দুই. ধাক্কা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী হাত। আবার যে ব্যক্তি তার ওপর বসা থাকে তাকেও শক্ত হয়ে বসে থাকতে হয়—যেন পড়ে না যায়। এই জাতি যখন গতি হারায় এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয় আল্লাহ তাদের জন্য একজন সংস্কারক প্রেরণ করেন, যিনি তাঁদের ধাক্কা দিয়ে গতি সৃষ্টি করেন।

আমি মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.)-কে এই সময়ের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক মনে করি। আমি মনে করি, যেখানেই দ্বিনি জ্ঞানের চর্চা আছে, যেখানেই সুন্নতের দাওয়াত আছে, যেখানেই শিরক ও বিদআত পরিহারের অনুপ্রেরণা ও তার প্রতি ঘৃণা আছে তা এই দুই মহান ব্যক্তির প্রচেষ্টার ফসল। মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.) ইসলামের ইতিহাসে এমন একজন মনীষী ছিলেন, যিনি উম্মতের গাড়ি এমন জোরে ধাক্কা দিয়েছেন যে সাড়ে তিন শ বছর যাবত তা চলছে এবং আল্লাহ ভালো জানেন তা কত দিন চলবে। তাঁর দেড় শ বছর পর শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর পরিবারের বিকাশ ঘটে। তাঁরা ভারতবর্ষে দ্বিনচর্চায় অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁদের সবচেয়ে বড় অবদান দ্বিনি চেতনা জাগ্রত করা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব জাগ্রত-চেতন মানুষ তৈরি করা। তাঁরা এ কাজটিই করেছিলেন। এখন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সময়সচেতন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করা, যারা সমকালীন সংকটগুলো বুঝবে এবং কোরআন-সুন্নাহর আলোকে তা সমাধান করতে পারবে। যারা সময়ের দাবি অনুযায়ী উম্মাহকে সঠিক পথ দেখাতে পারবে।

তামিরে হায়াত থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর

এই বিভাগের আরো খবর