শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পারিশ্রমিক ছাড়া গান নয়, ‘টোটালি বাজে কনসেপ্ট’ : কুমার বিশ্বজিৎ

বিনোদন ডেস্ক :  সংগীতাঙ্গনের সংকট দীর্ঘদিনের। অনুষ্ঠানে ঠিকমতো সম্মানী না পাওয়া, স্টেজ শো থেকে উপযুক্ত সম্মানী না পাওয়াসহ নানা ধরনের অসংগতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। এরই মধ্যে নতুন সংকট হচ্ছে করোনা। বর্তমানে শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে স্টেজ শো বা গানের আয়োজন। তবে এই পরিস্থিতিতে বেড়েছে অনলাইন লাইভ শো। ঘরে বসে এসব শোতে অংশ নিতে পারছেন শিল্পীরা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। শিল্পীরা বঞ্চিত তাদের প্রাপ্য সম্মানী থেকে। সামান্য সম্মানী, অনেক ক্ষেত্রে কোন প্রকার সম্মানী ছাড়াই এসব শো-তে অংশ নিতে হচ্ছে তাদের। আর তাই শিল্পীরা এবার নিজেদের প্রাপ্য সম্মানী আদায়ের লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছেন। দিয়েছেন যৌথভাবে বিবৃতি। তারা জানিয়েছেন, পারিশ্রমিক ছাড়া আর কোথাও গান করবেন না। এদিকে অর্থের মাপকাঠিতে গানকে যুক্ত করতে চাইছেন না জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। শতাধিক শিল্পীদের এই সিদ্ধান্তকে ‘টোটালি বাজে কনসেপ্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন- শিল্পীরা পয়সা ছাড়া গাইবে না, ভালো কথা। তো সেটার জন্য জোট করে ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে কেন?’

জানা গেছে, করোনার কারণে অন্যান্য পেশার মানুষের মত বিপাকে পড়েছেন সংগীতশিল্পীরাও। তাদের আয়ের প্রধান উৎস স্টেজ শো। বিশ্বব্যাপী করোনা সঙ্কটে এই শো বন্ধ হয়ে আছে চার-পাঁচ মাস ধরে। আবার কবে সবাই স্টেজে ফিরতে পারবেন তারও ঠিক নেই। ঘরবন্দি সময়েও ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব, ওয়েব কিংবা টিভিতে বিনা মূল্যে শো করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে শিল্পীদের। এত দিন কেউ কেউ বিনা মূল্যে এসব শো করলেও এখন থেকে সেটি আর হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন জোটবদ্ধ শতাধিক শিল্পী।গত ২৪ জুন থেকে নিজেদের ফেসবুক পোস্টে বিষয়টির জানান দেন তারা। এসব শিল্পীর মতে, সামনে অন্তত আরো এক-দেড় বছর এভাবে ঘরবন্দি থাকতে হবে আমাদের। কারণ এই মহামারি থেকে ধীরে ধীরে পরিত্রাণ পাওয়া গেলেও স্টেজ শো আয়োজনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে আরো সময় লাগবে। এই অবস্থায় শিল্পীদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঘরে বসেও যদি শিল্পীরা বিনা মূল্যে শো করেন, তাহলে তাঁদের জীবন চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

‘শিল্পের সম্মানে শিল্পীদের বাঁচান’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে একত্রিত হয়েছেন শতাধিক শিল্পী। তাদের এই বিবৃতিতে সহমত প্রকাশ করেছেন অনেক সিনিয়র সঙ্গীত তারকা। এদের মধ্যে রয়েছেন- মো. রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, তপন চৌধুরী, এস আই টুটুল, দিনাত জাহান মুন্নী, ফরিদ আহমেদ, বাদশা বুলবুল, শফিক তুহিন, মুহিন খান, পারভেজ সাজ্জাদ, ইবরার টিপু, সাব্বির জামান, রোমানা ইসলাম, সালমা আক্তার, নিশীতা বড়ুয়া, আলম আরা মিনু, প্রতীক হাসান, কিশোর দাশ, পুলক অধিকারী, নোলক বাবু, অণিমা রায়, লিজা, লুইপা, পিন্টু ঘোষ সব আরও অনেকে।

তবে তাদের সঙ্গে নেই জনপ্রিয় সঙ্গীত তারকা কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘এসব দেখলে নিজেকে বড় একা আর অসহায় লাগে। তাই এসব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, আমার মন্তব্য কারোর ভালো লাগবে না। সারা দুনিয়ায় চলছে মহামারি আর মৃত্যুর মিছিল। আর আমার অনুজরা সেই সময়ে জোট করছে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে। এখানে যেন সম্মানটা গৌণ, সম্মানীটাই মুখ্য। যেখানে শিল্প আর শিল্পী সত্তা নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই, আছে সম্মানী তোলার চিৎকার।’

তিনি বলেন, ‘শিল্পীরা পয়সা ছাড়া গাইবে না, ভালো কথা। তো সেটার জন্য জোট করে ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে কেন? এটা নিয়ে স্টেটমেন্ট দেওয়ার কিছু নেই তো। পয়সার বিনিময়ে আমি একটা শোতে গান করবো, নাকি পয়সা দিয়ে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে নিজেকে তুলে ধরবো, সেটা তো একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়। সেই প্রশ্নটা বা সিদ্ধান্তটা কিন্তু কেউ তোলেনি। একজন শিল্পীর ভেতরে যদি সত্যিকারের শৈল্পিক বিষয়টা থাকে, সেখানে অর্থটা বড় বিষয় না। সেখানে সম্মানটা বড় বিষয়। তারপর অর্থ।’

জনপ্রিয় এই তারকা আরও বলেন, ‘আমি যত ছোট বা অ-জনপ্রিয় শিল্পীই হই না কেন, নিজের সম্মান বা ব্যক্তিত্বটা অর্থ দিয়ে বিবেচনা করবো না। যেখানে আমার সম্মানটা থাকবে, সেখানে দরকার হলে আমি ফ্রি গান করবো। সমস্যা নেই তো। এখনও আমি কুমার বিশ্বজিৎ অনেক কাজ করি, সম্মানী ছাড়া। আবার যেখানে আমার সম্মান থাকবে না, সত্তা থাকবে না, সেখানে তো টাকার বস্তা দিলেও যাবো না।’

কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘এই যে শতাধিক ছেলেমেয়ে এক হয়েছে, একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হোক সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। এটা আমার ভালো লেগেছে। এই যে তারা এক হতে পেরেছে, এটাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এই ইউনিটির দরকার আছে। কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে এক হয়েছে ‘টাকা না দিলে গান গাবো না’—এটা টোটালি বাজে কনসেপ্ট। এটার জন্য আসলে একত্রিত হওয়ার কিছু নেই। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আরও ১০১টা জরুরি ইস্যু আছে, যেগুলো নিয়ে এক হওয়ার দরকার আগেও ছিল, এখনও আছে। সেগুলো নিয়ে আমাদের কোনও জোট হয় না। প্রতিবাদ হয় না। কে কোথায় কীভাবে গাইবে, সেটা তো যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে যারা আছে, তারা প্রত্যেকে আঠারো প্লাস। সবাই সব বোঝে। সে কার শো করবে, কোন শো করবে না, প্রত্যেকে ভালো বোঝে। আমার চেয়েও ভালো বোঝার লোক আছে এদের মধ্যে। তাহলে এই ইস্যুতে জোট করার কী আছে?’

উল্লেখ্য, গত বুধবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসে শতাধিক শিল্পীর পক্ষ থেকে। ‘শিল্পের সম্মানে- শিল্পীদের বাঁচান’ এমন স্লোগান দিয়ে শুরু করা হয় বিবৃতিটি।

তাতে বলা হয়- করোনার ছোবলে এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা। আর তাই এখন সব কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং সংগীত সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রিত হওয়ার সময়।

পরিচ্ছন্ন গান প্রাণে আশার আলো সঞ্চার করে। গানের ভূমিকা এবং শক্তি অপরিসীম। সেই গানকে আমরা যারা ভালোলাগা/ভালোবাসা আর পেশা হিসেবে নিয়ে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তারা বর্তমানে এক কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে আছি।
আমরা জানি, দর্শক-শ্রোতারাই শিল্পের শক্তি। কিন্তু করোনার ছোবলে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার্থে তা আজ অসম্ভব। লোকসমাগম এবং সংগীতের পরিবেশ ফিরে পাওয়া আজ অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আটকে গেছে ।

উন্নত দেশের সংগীত সংশ্লিষ্টরা যখন ঘরে বসেই প্রযুক্তির মাধ্যমে উপার্জন করছেন, তখন নানা জটিলতায় আমরা এই উপার্জন থেকেও অনেক দূরে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে টেলিভিশন বা অন্যান্য মাধ্যমে স্পন্সর নিয়ে যারা নিয়মিত অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করছেন তাদের ধন্যবাদ।

তবে ইদানীং আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে; যেমন- ফেসবুক, জুম, স্ট্রিমইয়ার্ড বা নানা মাধ্যমে লাইভ টকশো কিংবা মিউজিক্যাল অনুষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। যা প্রশংসনীয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে আয়োজনের সম্মানী থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সংগীতযোদ্ধারা। অনেকের অপেশাদার কর্মকাণ্ডে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ শিল্প ও শিল্পীর পেশাগত জায়গা।

তাই বর্তমান এই সংকটময় অবস্থায় শিল্পী সম্মানী ও এই শিল্প বাঁচানোর প্রেক্ষিতে আমরা এক হয়েছি।

এই বিভাগের আরো খবর