মঙ্গলবার, ৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নিউ ইয়র্কে ফাহিম হত্যাকাণ্ড ঘিরে অনেক প্রশ্ন

ডেস্ক নিউজ : বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ তথ্য প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রহস্য ঘণীভূত হচ্ছে। পুলিশ এখনো এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তবে তারা বলছে, অত্যন্ত পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ ফাহিমের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বা এনওয়াইপিডির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও খুনিকে ধরার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠাও’ সার্ভিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ৩৩ বছর বয়সি ফাহিম সালেহ। পরবর্তীকালে তিনি নাইজেরিয়ায় “গোকাডা” নামে একটি রাইড শেয়ারিং কম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে কলম্বিয়াতেও তার ব্যবসা ছিল।

সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আমেরিকার প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোয় ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হচ্ছে। সিএনএন-এর খবরে বলা হয়েছে, “ফাহিমকে সবশেষ সোমবার (১৩ জুলাই) বিকেলে দেখা গেছে। তিনি নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার জন্যে লিফটে উঠছিলেন। সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে তখন একই সাথে লিফটে উঠতে দেখা গেছে”।

পুলিশকে উদ্ধৃত করে সিএনএন আরও বলছে, “ঐ ব্যক্তিই ফাহিম সালেহর সম্ভাব্য হত্যকারী।”

সূত্র বলছে, সেদিন লিফটটি সরাসরি ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্ট যে তলায়, সেখানে পৌঁছে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সন্দেহভাজন হত্যাকারী পেছন পেছন পেছন বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে তার ওপর আক্রমণ চালায়।

অন্য একটি খবরে বলা হয়েছে, ফাহিমের সাথে লিফটে ওঠা সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি স্যুট, হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরা ছিল। তাঁর হাতে ছিল একটি ব্রিফকেস।

হত্যার ধরন দেখে, হত্যাকারীকে পেশাদার বা ভাড়াটে খুনি বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। ফাহিম সালেহর শরীরের বিভিন্ন অংশ অ্যাপার্টমেন্টে ছড়ানো ছিটানো ছিল এবং কিছু অংশ একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সূত্র বলছে, বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে ফাহিমের গলা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে কয়েক টুকরা করা হয়।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারেন ফাহিম সালেহর বোন। তার বোনকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, মঙ্গলবার সারাদিন ফাহিম সালেহর সাথে কোনো যোগাযোগ না হওয়ায় বিকেল ৩:৩০ মিনিটে সপ্তম তলায় তার সাথে কথা বলতে যান। সেখানে গিয়ে তার বোন ফাহিম সালেহর খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ দেখতে পান। পরে তার ফোন পেয়ে সেখানে পুলিশ যায়।

সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এনওয়াইপিডি পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে। বিশেষ করে হত্যাকারী কিভাবে এবং কোন পথে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ভবনটি থেকে বের হয়ে গেল, সেটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। হত্যাকারি একই লিফটে করে সপ্তম তলায় উঠেছে। সেখান থেকে নেমে অনুসরণ করে ফাহিমের ফ্লাটে ঢোকার সময় ধস্তাধস্তি হয়েছে বলে লিখেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। কারা, কী উদ্দেশ্যে ফাহিমকে হত্যা করলো সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খোঁজা হচ্ছে পেছনের চক্রটিকে।

বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভেঙে পড়েছে ফাহিমের পরিবার। গভীর কালো মেঘ নেমে এসেছে তাদের ওপর। পরিবারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ফাহিমকে যতটা বলা হচ্ছে, সে তার চেয়েও অনেক বড় মাপের মানুষ। যারা এই ঘৃণ্য ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে এনওয়াইপিডি ও গোয়েন্দারা নিরলস কাজ করবে, দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে, এটাই এখন চাওয়া।”

ফাহিমের প্রতিষ্ঠিত নাইজেরিয়ার রাইড শেয়ার প্রতিষ্ঠান “গোকোডা” এক টুইটে এই ঘটনায় গভীর শোক জানিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডকে তারা “আকস্মিক” ও “করুণ” বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলছে, “ফাহিম আমাদের সকলের জন্য দুর্দান্ত নেতা, অনুপ্রেরণা এবং ইতিবাচক আলো ছিলেন।”

এদিকে সদা হাস্যোজ্জ্বল ফাহিম সালেহর মৃত্যুতে প্রবাসীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তারা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। খুব অল্প বয়সে নিজের মেধার গুণে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার পরও, তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না; এমনটা উল্লেখ করে শোকে ভেঙে পড়েছেন তার বন্ধুরা।

সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাই স্কুলে পড়ার সময়ই প্রার্ক ডায়াল ডট কম নামে একটি প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফাহিম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রি রেকর্ডের প্রাঙ্ক কল করা হতো। শুরু হওয়ার পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় হয়। এরপর তার কৈশোর এবং বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমে পড়ার সময়ও নানান উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন তিনি।

একজন প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের। প্রায়ই কথা বলতেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে। গত ফেব্রুয়ারিতে সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন নাইজেরিয়ায় তার ব্যবসা সম্পর্কে।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নাইজেরিয়াতে ‘গোকাডা’ নামে একটি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করেন তিনি। তাঁর সাথে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আরো একজন ছিলেন। খবরে বলা হয়েছে, সেখানে মোটসাইকেল ভিত্তিক রাইড “গোকোডা” চালুর পর পাঁচ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূলধন ও ৮০০ ড্রাইভার তালিকাভূক্ত হয়েছিল। পরে দেশটির রাজধানী লেগোসে বাণিজ্যিক মটরসাইকেল চালনা নিষিদ্ধ করা হলে, ফাহিমের কম্পানি সমস্যায় পড়ে যায়। এরপর থেকে কম্পানিটি চালিয়ে নেয়ার জন্য বিকল্প খুঁজতে থাকেন তিনি। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে ‘গোকাডা’ পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে।

টেককাবাল নামে নাইজেরিয়ার একটি প্রযুক্তিবিষয়ক গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে বলছে, সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই ‘গোকাডা’ ৫৩ লাখ ডলার আয় করে। সম্প্রতি “অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগে উদ্যোগী হন।

ফাহিম সালেহর জন্ম ১৯৮৬ সালে সৌদি আরবে। পরে বাবা-মায়ের সাথে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন। এখানেই তার পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা। তাঁর বাবা সালেহ উদ্দিন চট্টগ্রামের, আর মা নোয়াখালীর বলে জানা গেছে। ২০১৪ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকায় গিয়ে “পাঠাও” চালু করে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। একই সাথে নেপালেও পাঠাও-এর সেবা চালু করা হয়। জানা গেছে, তিনি পাঠাওয়ের নিজের শেয়ার বিক্রি করে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশে এ ধরনের ব্যবসা শুরু করেন।

এই বিভাগের আরো খবর


Mersin rus escortMersin rus escort