মঙ্গলবার, ৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নবীজীর রওজায় আমাদের সালাম পৌঁছে দিও।

‘‘কবর জিয়ারতে তুমি/ কে যাও মদীনায়
আমার সালাম পৌঁছে দিও/ নবীজীর রওজায়’’

বাংলা গজলের এ পঙক্তি শোনার পর মুসলিমদের হৃদয়ে আবেগের তুফান সৃষ্টি হয়। কারণ, প্রতি বছর পবিত্র হজ্জের মৌসুমে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান পবিত্র হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফে গমন করেন। আল্লাহর হুকুম হজ্জের সমস্ত আহকাম পালনের পাশাপাশি মদীনা মোনাওয়ারায় প্রিয়নবী (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের পরম সৌভাগ্য লাভে ধন্য হন।

প্রিয় নবীজী (সা)-এর রওজা মোবারকের সামনে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সা)-এর প্রতি সালাম পেশের মাধ্যমে নবী প্রেমে বিভোর হয়ে উঠেন। সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন প্রকৃত আশেকে রাসূল। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁদেরকে মনোনীত করেছিলেন তাঁর পিয়ারা হাবীব (সা.)-এর সান্নিধ্য, সাহচর্য ও সহযোগিতার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করার জন্য। ঈমানের উত্তাপ বুকে নিয়ে একবার মাত্র যারা আল্লাহর হাবীব (সা.)-কে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, নবী-রাসূলগণের পর তাঁরাই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। কোন ওলি-আউলিয়া, গাউস-কুতুব পর্যন্ত তাঁদের পদধুলির সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারবেন না।

আল্লাহর পিয়ারা হাবীব (সা.) যতদিন দুনিয়াতে ছিলেন সাহাবায়ে কেরামের সব আনন্দ-উল্লাস আর উৎসাহ-উদ্দিপনা আবর্তিত হত পিয়ারা নবী (সা.)-এর পবিত্র দু’টি পদযুগলকে কেন্দ্র করে। তাঁরা ছুটে আসতেন আলোক পিয়াসী পতঙ্গের মত। আবেগ ভরে একবার মাত্র পিয়ারা নবী (সা.)-এর চেহারা মোবারক দর্শন করে তাঁরা সকল দুঃখ-বেদনা ভুলে যেতেন। ক্লান্তিময় কর্মজীবনের অবসান লগ্নে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যখন তাঁর পিয়ারা হাবীব (সা.)-এর জন্য পাক মদীনার শীতল মাটির বুকে চির আরামের শয্যা রচনা করে দিলেন তখন থেকেই রওজা পাকের পবিত্র আঙ্গিনাই ছিল সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এবং তাঁদের পরবর্তী সকল ভক্তজনের আধ্যাত্মিক শান্তি ও উদ্দিপনা লাভের প্রধানতম কেন্দ্রবিন্দু।

ইসলামের ব্যাপক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামকেও ইসলামী খেলাফতের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেতে হয়। কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু সুযোগ পেলেই তারা ছুটে আসতেন পবিত্র রওজা শরীফের পাশে। আবেগভরে সালাম নিবেদন করতেন প্রিয়তম নবী (সা.)-কে। অনুরূপভাবে মদীনা শরীফ থেকে কোথাও বের হয়ে যাওয়ার পূর্বেও তাঁরা অবশ্যই হাজির হতেন রওজা শরীফের পাশে।

জীবদ্দশায় রাসূল (সা.)-এর পবিত্র সান্নিধ্য ছিল যেমন পরম সৌভাগ্যের কারণ, তেমনি তাঁর পবিত্র রওজা জিয়ারতও একটি অনন্ত সৌভাগ্যের উপায়। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক (সা.) স্বয়ং এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করবে তার জন্য শাফাআত করা আমার কর্তব্য হয়ে যাবে।’ এ প্রাজ্ঞ সাহাবী আরও বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো গরজ তাড়িত না হয়ে শুধুমাত্র আমার কবর জিয়ারত করতে আসবে, তার জন্য পরকালে শাফাআত করা আমার কর্তব্য হয়ে যাবে এবং কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকারী হব।’

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) আরও বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ওফাতের পর আমার কবর জিয়ারত করবে, সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলে খোদা (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো, কিন্তু আমার কবর জিয়ারত করলো না, সে যেন আমার প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ করলো।

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেদিন মক্কা থেকে বের হয়ে গেলেন, সেদিন থেকে যেন এই নগরীর সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আর যেদিন তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করলেন সেদিন থেকেই এ পবিত্র জনপদের সবকিছু যেন আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, মদীনা আমার বাসস্থান। এখানেই আমার কবর হবে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হল এ পবিত্র নগরী জিয়ারত করা।

উপরোক্ত কয়েকখানা নির্ভরযোগ্য হাদীস তথা বর্ণনা এবং আরও বহু সহীহ্ হাদীসের আলোকে অনেক ফেকাহ্বিদই এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপরই ওয়াজিব হল রাসূলে-মকবুল (সা.)-এর কবর শরীফ জিয়ারত করা এবং সেখানে হাযির হয়ে দরূদ ও সালাম পেশ করা। অপর পক্ষে যাদের সামর্থ্য আছে, এরূপ লোকের পক্ষে রওজা শরীফের জিয়ারত না করা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের কারণ।

আর উম্মতে মুহাম্মদীর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক মুমিন-মুমিনার একান্ত কর্তব্য হচ্ছে, সামর্থ্যবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পাক মদীনার যিয়ারতে ছুটে যাওয়া এবং সেখানে পৌছে নিতান্ত আবেগ ও আদবের সাথে দরুদ ও সালাম পেশ করা। অতঃপর দিন কয়েক পাক মদীনায় অবস্থান করে হৃদয়-মন শান্ত করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা। এখন কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, এই ব্যস্ত জীবনে কেন আমি নিজের মূল্যবান সময় ও অর্থ ব্যয় করে মদীনা মুনাওয়ারা সফর করব?

এর সোজাসাপ্টা উত্তর এই যে, লাভালাভের হিসেবেও এই পবিত্র সফর অত্যন্ত লাভজনক। কেননা, আমরা যদি ষাট-সত্তর বছরের যাপিত-জীবনের সুখ-সুবিধার কথা চিন্তা করে সুদীর্ঘ ত্রিশ-চল্লিশ বছরের কর্মব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করতে পারি, তাহলে যিনি আমাদের অনন্ত জীবনের কান্ডারির ভূমিকায় কাল হাশরে প্রধান নিয়ামকের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আঞ্জাম দিবেন, তাঁর পবিত্র রওজায় সারা জীবনে মাত্র কয়েক দিনের জন্যও কি আমরা হাজিরা দিব না!

অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মানব সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ জামায়াত তথা সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ বিগত চৌদ্দ’শ বছরের প্রতি শতাব্দীতে জন্মগ্রহণকারী মুসলিম উম্মাহর কালজয়ী মনীষীগণের প্রত্যেকেই তাঁদের যাপিত-জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক সময় রওজায়ে আকদাসের একান্ত সান্নিধ্যে পাক মদীনায় অতিবাহিত করে গেছেন।

তাই উম্মতে মুহাম্মদীর বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রত্যেক বিবেকবান সদস্যের উচিত কয়েকটি বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা যে, তার জন্মের বহু বছর পূর্বে কেউ একজন পিতা-মাতার চেয়েও অনেক অনেক বেশি তাকে ভালোবেসেছেন। উম্মতের উভয় জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর অতি মূল্যবান জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন। তার মাগফেরাতের জন্য সারারাত সেজদায় লুটিয়ে পড়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। তাকে ভালোবেসে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, প্রিয় স্বদেশভূমি ত্যাগ করেছেন, অমানবিক নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেছেন, দিনের পর দিন অভূক্ত এবং অনাহারে থেকেছেন।

নিজের পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তান সবই ছিল তাঁর, এতদসত্ত্বেও প্রিয় উম্মতের নামে শত শত কোরবানী করেছেন। আমাদের গুনাহের জন্য, আমরা যাতে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ন্যায় ধ্বংস হয়ে না যাই, সেজন্য আমাদের হয়ে পূর্বাহ্নেই যিনি কেঁদে-কেঁটে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। যিনি সারাজীবনের অর্জিত সম্পদ স্ত্রী-সন্তানকে না দিয়ে আমাদেরকে দান করে গেছেন।

মহাজীবনে প্রাপ্ত আল্লাহর সকল নেয়ামত, রহমত ও আমানত জীবন সায়াহ্নে মহান আল্লাহ্কে সাক্ষী রেখে পাই-পাই করে আমাকে-আপনাকে সমর্পণ করে গেছেন। নিজের জন্য জীবনে যিনি কোনো কিছুই প্রত্যাশা করেননি, বরং যখনি কিছু চাইতেন, তখনি প্রথমে দু’হাত উঠিয়ে এই বলে প্রার্থনা করতেন : হে আমার পালনকর্তা! আমার উম্মত! আমার উম্মত! এবং দোয়া শেষও করতেন একইভাবে।

এমনিভাবে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যিনি ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি বলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর এখানেই শেষ নয়, বরং যিনি একদা তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে, হে ফাতেমা! রাসূলুল্লাহ্ তোমার পিতা, এই বলে কাল কেয়ামতে কোন উপকার আমি তোমার করতে পারবো না। বরং তোমার আমল দ্বারাই সেদিন তোমাকে পার হতে হবে। পক্ষান্তরে আমাকে-আপনাকে তিনি এই বলে সাহস যুগিয়েছেন এবং আস্বস্ত করেছেন যে, হে আমার উম্মত! তোমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না, কাল কেয়ামতের প্রতিটি কঠিন ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমি তোমাদের পাশে থাকবো, হাশরে, হিসাব-নিকাশে, হাউযে-কাউসারে, পুলসিরাতে সর্বত্র আমি তোমাদের একান্ত অভিভাবকরূপে তোমাদের পাশে থাকবো।

সেই কঠিন সময়ে যখন সমস্ত নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত পরিণামের ভয়ে কম্পমান থাকবেন, তখন তিনি শুধুমাত্র আমার-আপনার মুক্তির জন্য এগিয়ে এসে মহান আরশের মালিকের পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন। এক পর্যায়ে মহান আরশের মালিক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলবেন, হে মুহাম্মদ সা.! উঠুন এবং প্রার্থনা করুন, আজ আপনার সব প্রার্থনা মঞ্জুর করা হবে। যা চাইবেন, তা আপনাকে প্রদান করা হবে।

তখন তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলবেন, হে আল্লাহ্! হে বিচার দিবসের একচ্ছত্র মালিক! আমার উম্মত, আমার উম্মত, তখন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর উম্মতের এক বিরাট অংশ দেখিয়ে বলবেন-এদের আমি ক্ষমা করে দিলাম, আপনি এদেরকে সঙ্গে নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করুন। তিনি তাদের জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে পুনরায় ফিরে এসে সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন, এভাবে বারবার সেজদায় লুটিয়ে পড়ে লক্ষ-কোটি উম্মতের সর্বশেষ মানুষটিকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে তারপর তিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
অতএব, যিনি আপনার-আমার জন্য এতো ভালোবাসা ও এতো ত্যাগ সয়েছেন এবং সইবেন, তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রদর্শন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমার-আপনার সর্বোচ্চ মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধায় আল্লাহ্ পাক স্বয়ং এই মহানুভব নবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে আমাদের যাপিত জীবনের অন্যতম কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন :
تَسْلِيمًا وَسَلِّمُوا عَلَيْهِ صَلُّوا آمَنُوا الَّذِينَ أَيُّهَا يَا النَّبِيِّ عَلَى يُصَلُّونَ وَمَلَائِكَتَهُ اللَّهَ إِنَّ

অর্থাৎ, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর উপর দরূদ পাঠ করেন। অতএব, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ এবং সালাম প্রেরণ কর।” (সূরা আল আহযাব : ৫৬)

এই আয়াতে কারিমার সুস্পষ্ট অর্থ থেকে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করা উচিৎ, আর তা হচ্ছে এই যে, স্বয়ং রাব্বুল আলামীন রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর উপর দরুদ পাঠ করে থাকেন। অতএব, আমাদের তাঁর বান্দা তথা দাস হিসেবে সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তথা মহানবী (সা.)-এর শানে দরুদ পাঠ করা শুধু কর্তব্যই নয় বরং মহান ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ এক মাধ্যম।

আর তাই নির্ভরযোগ্য হাদীসের ভাষ্যমতে, যে ব্যক্তি নবী করীম (সা.)-এর নাম শোনার পর তাঁর শানে দরূদ পাঠ করে না, সে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে পরিচিত। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির উপস্থিতিতে আমার নাম উচ্চারিত হবে, কিন্তু আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে না, সে বড়ই কৃপণ।”

(তিরমিযী, ৫ম খ-, পৃ. ২১০)

নবী করীম (সা.) আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়ে তাঁর উম্মত এবং সমগ্র মানব জাতির উপর যে অতুলনীয় মহানুভবতা প্রদর্শন করেছেন এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপর সালাত ও সালাম অর্থাৎ, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা করা প্রতিটি উম্মতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আর দরূদ ও সালাম পাঠ করার মধ্যে মূলতঃ দরূদ ও সালাম পাঠকারীরই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তিই আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে আমার উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠ করে।”

(তিরমিযী, ৫ম খ-, পৃ. ২১০)

সুনানে নাসায়ীর অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ্ তা’আলা তার প্রতি দশবার রহমত অবতীর্ণ করেন এবং তার দশটি গুনাহ্ (সগিরা) মার্জনা করা হয় ও তার দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।”

(নাসায়ী, ৩য় খ-, পৃ. ৫৮ )

সহীহ্ হাদীসের ভাষ্যমতে নবী করীম (সা.) দরূদ ও সালাম প্রদানকারীর সালামের উত্তর দিয়ে থাকেন। সুনানে আবু দাউদের এক রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, “তোমাদের যে কেউ আমার উপর সালাম পাঠ করে, আল্লাহ্ তখনই আমার রূহ্ আমাকে ফেরত দেন এবং আমি তার সালামের জবাব দিয়ে থাকি।”

(আবু দাউদ, ২য় খ-, পৃ. ১৬৯)

যতবার দরূদ ও সালাম প্রদান করা হয় ততবার আল্লাহ্ পাক সংশ্লিষ্ট বান্দার উপর রহমত বর্ষণ করে থাকেন। সুনানে নাসায়ী ও দারেমী শরীফের অপর এক রেওয়ায়েতে হাদীসে কুদসীর বরাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, আর আপনার উম্মতের মধ্যে যে কেউ আপনার প্রতি একবার সালাম পেশ করবে, আমি (আল্লাহ্) তার প্রতি দশবার শান্তি বর্ষণ করব।”

(নাসায়ী, দারেমী)

দরূদ এবং সালাম পাঠের ক্ষেত্রে কতিপয় জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয় : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি যখন দরূদ পাঠ করা হয়, তা যদি তাঁর রওজার কাছে পাঠ করা হয়, তাহলে তিনি তা সরাসরি শুনে থাকেন। আর যদি দূর দেশ থেকে পাঠ করা হয়, তাহলে তা তাঁর নিকট দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশ্তা মারফত পৌঁছানো হয়। আর রওজা শরীফের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করলে তিনি তা শুনতে পান।

রাসূল (সা.) বলেছেন :
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ عِنْدَ قَبْرِيْ سَمِعْتُهُ وَ مَنْ صَلَّى عَلَيَّ نَائِيًا أُبْلِغْتُهُ

অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি আমার রওজার কাছে এসে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে তা আমি সরাসরি শুনতে পাই। আর যে দূরে থেকে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে তা আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।” (বায়হাকী : ২য় খ-, পৃ. ২১৫)

রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত একদল ফেরেশতা দূর থেকে দরূদ ও সালাম প্রদানকারী ব্যক্তির পরিচয়সহ তাঁর নিকট পৌঁছে দেন-
إِنَّ لِلَّهِ مَلاَئِكَةً سَيَّاحِينَ فِى الأَرْضِ يُبَلِّغُونِى مِنْ أُمَّتِى السَّلاَمَ

অর্থাৎ, “আল্লাহর কতক ফেরেশ্তা এমন রয়েছেন, যাঁরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেন এবং আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌঁছান।” (নাসায়ী, দারেমী)

উল্লেখিত হাদীস দু’টির মাধ্যমে একথাই প্রমাণ হয় যে, রাসূল (সা.)-এর প্রতি যেখানেই দরূদ ও সালাম পাঠ করা হয়, সেখানেই রাসূল (সা.) স্বশরীরে কিংবা আধ্যাত্মিকভাবে উপস্থিত হয় বলে কোন কোন লোকের যে ধারণা, তা সম্পূর্ণ ভুল এবং এটা র্শিকী আকীদার অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং এ ধরনের ধারণা বা আকীদা-বিশ্বাস পরিহার করা প্রয়োজন এবং সালাত ও সালাম তাঁর নিকট পৌঁছানোর নিয়তেই পাঠ করা উচিত।

আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বযুগের সকল ওলামায়ে-কেরামের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উপর জীবনে একবার দরূদ পাঠ করা ফরজ। এ ছাড়া যতবার তাঁর নাম কোন মুসলমান শুনবে ততোবার দরূদ পাঠ করা সুন্নত। উলামায়ে কেরামের কারো কারো মতে ওয়াজিব। (মেশকাত) প্রিয় উম্মতের প্রতি নবী করীম (সা.)-এর অতুলনীয় ভালোবাসার একটি খণ্ডচিত্র।

ইমাম ইবনে কাসীর হযরত আবু যর গিফারী (রা.)-এর বাচনিক বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) একবার সারারাত-عِبَادُكَ فَإِنَّهُمْ تُعَذِّبْهُمْ إِنْ
“যদি আপনি তাদের শাস্তিÍ দেন, তবে তারা আপনার দাস।” (সূরা আল-মায়িদাহ্ : ১১৮) আয়াতটিই পাঠ করতে থাকেন। ভোর হলে আমি আরয করলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সা.! আপনি এ আয়াতটিই পাঠ করতে করতে ভোর করেছেন। এ আয়াত দ্বারাই রুকু করেছেন এবং এ আয়াত দ্বারাই সেজদা করেছেন। তিনি বললেন : আমি পরওয়ারদেগারের কাছে নিজের জন্যে শাফায়াতের আবেদন করেছি। আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। অতি সত্ত্বরই আমি তা লাভ করব। আমি এমন ব্যক্তির জন্যেই শাফায়াত করতে পারব, যে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কোন শিরক তথা অংশীদার সাব্যস্ত করেনি।

সহীহ্ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) উপরোক্ত আয়াত পাঠ করে আকাশের দিকে হস্ত প্রসারিত করেন এবং বলেন : (اللهم أُمَّتِي) অর্থাৎ, হে পাক পরওয়ারদেগার, আমার উম্মতের প্রতি করুণার দৃষ্টি দাও। অতঃপর তিনি কাঁদতে থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে এভাবে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি হযরত জিবরাঈলকে উপরোক্ত উক্তি শুনিয়ে দেন। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈলকে বললেন : তা হলে যাও এবং (হযরত) মুহাম্মদ (সা.)-কে বলে দাও যে, আমি অতিসত্ত্বর আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব-অসন্তুষ্ট করব না। (সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল-ঈমান : ২০২)

মোটকথা, রওজা শরীফে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে দরুদ ও সালাম পেশ করা যে নিতান্ত সৌভাগ্য এবং রূহানী উন্নতি লাভ করার বিশেষ একটি উপায়, এ ব্যাপারে বিগত যুগের ইমাম ও পৃথিবীর সমস্ত ফেকাহবিদগণ একমত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজ্জ করতে যাওয়া আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওজা শরীফ জিয়ারতের আনন্দময় মুহূর্তে আমার দেশের একজন নবী-প্রেমিকও যদি আমাদের সালাম রওজা পাকে পৌঁছে দেন, তার প্রতি আমাদের বুকভরা ভালোবাসা ও চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবে।

আমাদের পক্ষ থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি রইল হাজারো লক্ষ সালাম। “আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া সাইয়িদি ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

এই বিভাগের আরো খবর


Mersin rus escortMersin rus escort